টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য কোরাম সংকটেই অপচয় শত কোটি টাকা

অঅ-অ+
নবম জাতীয় সংসদে শুধু কোরাম সংকটে সময় অপচয়ের কারণে ১০৪ কোটি টাকারও বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আর বিরোধী দলের সংসদ বর্জনে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। সংসদের প্রধান কাজের মধ্যে অন্যতম আইন প্রণয়নে অংশ নিয়েছেন মাত্র ৫৩ জন। একটি আইন বা বিল পাস করতে সময় ব্যয় হয়েছে মাত্র ১২ মিনিট। সংসদে রাজনীতিবিদ ও আইনজীবীদের প্রতিনিধিত্ব দিন দিন কমছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব দিন দিন বেড়ে শতকরা ৫৭ ভাগে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবির ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের হার ক্রমাগত বেড়ে নবম সংসদে ৮১ দশমিক ৫৮ ভাগ কার্যদিবসে এসে দাঁড়িয়েছে। অষ্টম সংসদে এই হার ছিল ৬০ ভাগ। সংসদ বর্জনের এ সংস্কৃতি বিশ্বে অদ্বিতীয়। এটি যেমন বিব্রতকর তেমনি জনগণের ভোট ও রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতার পরিচায়ক।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টায় রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির দুই ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোরশেদা আক্তার ও ফাতেমা আফরোজ এবং প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুলিয়েট রোজেটি। উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান ও নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানসহ কর্মকর্তারা।
কোরাম সংকট : নবম সংসদে মোট ১৯টি অধিবেশনে ৪১৮ কার্যদিবসে কোরাম সংকটে সময় অপচয় হয়েছে ২২২ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট। নির্ধারিত সময়ে অধিবেশন শুরু ও নামাজের বিরতি দিয়ে আবার শুরু করতে গড়ে প্রতিটি কার্যদিবসে সময় অপচয় হয়েছে ৩২ মিনিট করে। প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী সংসদ পরিচালনা করতে প্রতি মিনিটে গড়ে খরচ হয় প্রায় ৭৮ হাজার টাকা। ফলে কোরাম সংকটের কারণে প্রতি কার্যদিবসে অপচয় হওয়া সময়ের অর্থমূল্য প্রায় ১০৪ কোটি ১৭ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, সংসদ অধিবেশনে প্রতিদিন গড়ে উপস্থিত থেকেছেন ২২১ জন সদস্য, যার হার শতকরা ৬৩ ভাগ। ৪১ ভাগ সদস্য ৭৫ ভাগের বেশি এবং ১৪ ভাগ সদস্য চার ভাগের এক ভাগের কম কার্যদিবসে উপস্থিত ছিলেন। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে খালেদা জিয়া ৪১৮ কার্যদিবসের মাত্র ১২ কার্যদিবস এবং অষ্টম সংসদে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা ৩৭৩ কার্যদিবসের মধ্যে ৪৫ দিন উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রীদের মধ্যে ৩২ দশমিক ৭ ভাগ তিন-চতুর্থাংশের বেশি, ৫৩ দশমিক এক ভাগ অর্ধেকের বেশি এবং ১৪ দশমিক ৩ ভাগ মন্ত্রী অর্ধেকের কম কার্যদিবসে উপস্থিত ছিলেন।
সংসদ সদস্যদের পেশার ধরন : সংসদে আইনজীবী ও রাজনীতিকদের প্রতিনিধিত্ব দিন দিন কমে বাড়ছে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা। টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক সময় সংসদে আইনজীবীদের শতকরা হার বেশি থাকলেও দিন দিন তা কমে আসছে। বাড়ছে ব্যবসায়ীদের হার। বর্তমানে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের হার বেড়ে শতকরা ৫৭ ভাগে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে আইনজীবীদের ১৪ এবং রাজনীতিবিদ, শিক্ষক ও সাংবাদিকদের হার শতকরা ৭ ভাগে নেমে এসেছে।
ওয়াক আউট : নবম জাতীয় সংসদে ৩৮টি কার্যদিবসে বিভিন্ন দাবিদাওয়া ও প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ৫৪ বার ওয়াক আউটের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে প্রধান বিরোধী দল ওয়াক আউট করেছে ৪১ বার আর স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিম করেছেন একাই ১৩ বার। রাষ্ট্রপতির ভাষণ, মন্ত্রীসহ সরকারদলীয় সদস্যদের বক্তব্য ও অসৌজন্যমূলক আচরণ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পুনর্গঠন, সংসদ কক্ষে আসন বিন্যাস, বিল পাস ও পাসের সময় চাহিদা অনুযায়ী সময় বরাদ্দ না পাওয়া, পয়েন্ট অব অর্ডারে কথা বলার সুযোগ না দেওয়া ইত্যাদির প্রতিবাদে এসব ওয়াক আউট হয়েছে।
আইন প্রণয়নে কম সময় ব্যয় : আইন প্রণয়ন জাতীয় সংসদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হলেও এই কাজে সময় ব্যয় হয়েছে কম সময়। নবম জাতীয় সংসদে একটি বিল পাস করতে সময় নেওয়া হয়েছে গড়ে ১২ মিনিট। টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের লোকসভায় যেখানে শতকরা ৬০ ভাগ বিল পাসের ক্ষেত্রে আলোচনা হয় এক থেকে দুই ঘণ্টা। বাংলাদেশে নবম সংসদে মোট সময়ের মাত্র ৮ দশমিক ২ ভাগ সময় ব্যয় করা হয়েছে আইন প্রণয়নে। ১৮ মিনিটে দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) বিল-২০১১, প্রায় ৫ মিনিটে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী দ্রুত বিচার (সংশোধন) বিল-২০১০, ১০ মিনিটে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) বিল-২০১১ এবং উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) বিল-২০১১, ৩ মিনিটে তথ্য অধিকার বিল-২০০৯, ১৫ মিনিটে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) বিল-২০১০, ১১ মিনিটে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিল-২০০৯ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) বিল-২০১৩ পাস করা হয় ৪ মিনিটে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে (নবম) আইন প্রণয়নে মোট সময়ের মাত্র ৮ দশমিক ২ ভাগ সময় ব্যয় করা হয়েছে। অথচ যুক্তরাজ্যে ৫৫ ভাগ (২০০৯-১০) এবং ভারতে ৫৩ ভাগ সময় ব্যয় করা হয়। নবম সংসদে ২৭১টি বিল পাস করা হয়েছে, যার মধ্যে ২৬৮টি সরকারি ও ৩টি বেসরকারি। সময় ব্যয় হয়েছে ১০৯ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট। ১৫ জন সংসদ সদস্য বিল উত্থাপন করেছেন এবং ৫৩ জন আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।
বেশি সময় ব্যয় বাজেট আলোচনায় : নবম জাতীয় সংসদে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় হয়েছে বাজেট আলোচনায়। পাঁচটি বাজেট অধিবেশনের মোট সময়ের ২১ দশমিক ৮ ভাগ ব্যয় হয়েছে এতে। মোট ২৮৯ ঘণ্টা ৫৭ মিনিট আলোচনায় অংশ নিয়েছেন ৩১৮ জন সদস্য। শেষ বাজেট অধিবেশনে বিরোধীদলীয় জোটের ৩৩ জন সদস্য আলোচনায় অংশ নেন। ৩২ জন সদস্য কোনো বাজেট আলোচনায়ই অংশ নেননি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আলোচনায় অংশগ্রহণকারী সদস্যরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাজেট সম্পর্কিত আলোচনার বাইরে দলীয় প্রশংসা, প্রতিপক্ষ দলের সমলোচনা এবং অপ্রাসঙ্গিক বিষয় তুলে আনেন।
রাষ্ট্রপতির ভাষণ : নবম সংসদে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সময় ব্যয় হয়েছে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায়। এই হার মোট সময়ের শতকরা ১৬ দশমিক ৫ ভাগ। ২৯৯ জন সদস্য কোনো কোনো অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। ৭৮ জন সদস্য পাঁচটি অধিবেশনেই রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় অংশ নেন আর ৫১ জন কোনো অধিবেশনেই অংশ নেননি। আলোচনায় নিজ দলের প্রশংসা, প্রতিপক্ষ দলের সমালোচনা এবং অসংসদীয় ভাষায় প্রয়াত রাষ্ট্রনেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন। বক্তব্যে থাকে এক দল আরেক দলকে আক্রমণ ও অসংসদীয় আচরণ।
স্পিকারের ভূমিকা : টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংসদে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার উভয়ই সরকারদলীয় হওয়ায় সংসদ পরিচালনার ক্ষেত্রে দলীয় প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেন না। বিরোধী দলের সদস্যদের কটাক্ষ করে সরকারদলীয় সদস্যদের বক্তব্য দিলে স্পিকারকে অনেক সময় নীরব থাকতে দেখা যায়।  তবে সদস্যদের অসংসদীয় ও অশালীন ভাষা ব্যবহার বন্ধে স্পিকারের রুলিং এবং দলমত-নির্বিশেষে সব সদস্যের প্রতি আন্তরিক সহযোগিতা ও সহনশীল আচরণ এবং আহ্বান ইতিবাচক পদক্ষেপ। নবম সংসদে স্পিকার ৭১২ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট, ডেপুটি স্পিকার ১৫২ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট এবং সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ১০৬ ঘণ্টা ১৪ মিনিট অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছেন।
ইতিবাচক দিক : অষ্টম জাতীয় সংসদের তুলনায় নবম সংসদে সদস্যদের উপস্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩ ভাগে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও সরকারদলীয় সদস্যদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ ছিল। বাজেট আলোচনায় খাতভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ, সংশোধনী প্রস্তাব, নতুন পরিকল্পনা, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থতার সমালোচনা ছিল ইতিবাচক পদক্ষেপ। প্রশ্নোত্তর, জনগুরুত্বপূর্ণ নোটিশ ইত্যাদি পর্বে নারী সদস্যদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য।
নেতিবাচক দিক : নবম সংসদে বিরোধী দলের সংসদ বর্জন ও এর মাত্রা সংকটজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্ব ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। অষ্টম সংসদের তুলনায় নবম সংসদে আইন পাসে কম সময় ব্যয় করা হয় এবং কমসংখ্যক সদস্য অংশ নেন। সংবিধানে স্পষ্ট থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক চুক্তি নিয়ে সংসদে আলোচনা করা হয়নি। সংসদে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার, সংসদ অধিবেশন ও কমিটির বৈঠকে কোরাম সংকট একটি নেতিবাচক দিক ছিল। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে মত প্রকাশে প্রতিবন্ধকতা, যা নবম সংসদেও ছিল। মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোয় মন্ত্রীরা সদস্য ছিলেন, যা কার্যপ্রণালী বিধির ১৮৮ (২)-এর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সরকারি দল নির্বাচনী ইশতেহারে সদস্যদের আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বিরোধী দলের মধ্য থেকে একজন ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন এবং স্পিকারের দল থেকে পদত্যাগের আলোচনা করলেও সরকার তা বাস্তবায়ন করেনি।
টিআইবির ২২ জন কর্মকর্তা এই গবেষণায় অংশ নেন। ট্রাস্টি বোর্ডের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। প্রতিবেদন তৈরিতে সংসদ টেলিভিশন, জাতীয় সংসদের বুলেটিন, সরকারি গেজেট, প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন ও বই এবং সংবাদপত্রের সহযোগিতা নেওয়া হয় বলে জানানো হয়েছে।

 

Published by Amjonotablog

i am simple person

Leave a comment